সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর জীবনী

একজন অবিসংবাদী ভাষাতাত্ত্বিক হিসাবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় খ্যাতি লাভ করলেও তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল সুবিশাল। মানব সংস্কৃতির এমন কোনও বিষয় নেই যার সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর অণ্বেষা ছিল না। সমগ্র জীবনকালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে বইগুলি লিখেছেন , সেসবের মধ্যে ধরা পড়ে তার সর্বব্যাপী জ্ঞানের পরিচয়।সুনীতিকুমারের জ্ঞান ও মেধার পরিচয় দিতে গিয়ে দেশ ও বিদেশের বুধমন্ডলী তাঁকে এনসাইক্লোপিডিস্ট অভিধায় ভূষিত করেছেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুনীতিকুমার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজদের সদাগরি অফিসের কেরানি। তিনি মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে ১৯০৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করে কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯০৯ সালে ৩য় স্থান অধিকার করে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। অতঃপর প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯১১ সালে ইংরেজিতে সম্মানসহ বি.এ শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন।
১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ শ্রেণিতে ১ম স্থান অর্জন করেন।১৯১৮ সালে সংস্কৃতের শেষ পরীক্ষায় পাস করেন এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি এবং জুবিলি গবেষণা পুরস্কার অর্জন করেন।কৃতিত্বের সাথে এম.এ ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯১৪ - ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯১৯ সালে তিনি ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় লন্ডনে যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট ডিগ্রি লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তু ছিল 'ইন্দো-আরিয়ান ফিললজি'। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে তিনি ধ্বনিতত্ত্ব ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্ব ছাড়াও প্রাকৃত ভাষা, ফার্সি ভাষা, প্রাচীন আইরিশ ভাষা, পুরনো ইংরেজি ও গোথিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। অতঃপর লন্ডন থেকে তিনি প্যারিসে গমন করেন।
সেখানে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভ ও ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাতত্ত্ব, প্রাচীন সগডিয়ান ও প্রাচীন খোতানি ভাষা, গ্রিক ও লাতিন ভাষার ইতিহাস এবং অস্ট্রো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়াটিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ সালে দেশে ফিরে আসার পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের 'খয়রা' অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় কর্মজীবন শুরু করেন।
এখানে দীর্ঘ ৩০ বছর কাজ করার পর ১৯৫২ সালে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে পুনঃনিযুক্ত হন।অধ্যাপক তারাপুরওয়ালা'র কাছে আবেস্তা অধ্যয়ন করেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ৩ খণ্ডের দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থখানি রচনা করে অসাধারণ বিদ্যাবত্তার পরিচয় প্রদান করেন।অন্যান্য রচনাবলি হলো: বেঙ্গলি ফোনেটিক রিডার, কিরাত জনকৃতি, ভারত-সংস্কৃতি, বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা পশ্চিমের যাত্রী, ইউরোপ ভ্রমণ, জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য, ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি কী, দ্বীপময় ভারত, রবীন্দ্র সঙ্গমে, শ্যামদেশ ইত্যাদি।এই মহান মানুষটি ২৭ শে মে ১৯৭৭ সালে পরলোকগমন করেন।