জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বাঙালি নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা, সম্পাদক ও চিত্রশিল্পী।  স্বকীয় প্রতিভা ছাড়াও অন্যান্য প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করার বিরল ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। তিনি তার ছোটোভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনী সম্পর্কে।

 দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর থেকে বারো বছরের ছোটো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসাহ ও সঙ্গ দিয়ে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করেন। তাঁদের দুই দাদা কবি ও দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বনামধন্য ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছোটোবোন স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট লেখিকা ও সংগীতজ্ঞা।

  বাল্যকালে দাদা হেমেন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। পরে তিনি সেন্ট পলস ও মন্টেগুস স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৬৪ সালে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁর সহপাঠী। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে ফার্স্ট আর্টস পড়ার সময় থিয়েটারে আকৃষ্ট হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

 ১৮৬৭ সালে বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমেদাবাদে থাকার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেতার বাজাতে ও ছবি আঁকতে শেখেন। তিনি ফরাসি ও মারাঠি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। বিভিন্ন ভাষার বই, বিশেষ করে নাটক তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াসএর মেডিটেশনস ও শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন। পিয়েরে লোতি ওথিওফিল গুটিয়ার ছাড়াও তিনি ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস ও ছোট গল্প ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন।

  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শৈশবে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীত বিষয়ে তালিম নেন। তিনি পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম ও সিতার বাজানোতে দক্ষ ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত বিপ্লবে মূল ভূমিকা ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। সাহিত্য ও সংগীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী। পরে রবীন্দ্রনাথ তাদের সাথে যোগ দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সুরারোপ করতেন ও পিয়ানো বাজাতেন এবং অক্ষয় ও রবীন্দ্রনাথ সুরগুলোতে কথা যোগ করতেন। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মায়ের খেলায় ব্যবহৃত ২০ টি গানের সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

 স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সে যুগে অপরিকল্লপিত বিষয় ছিল। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।তাঁর নিজের নিজের সংসারে পর্দা প্রথাকে তিনি আমল দেননি, স্ত্রীকে সকলের সম্মুখে বের করতেন, তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে সান্ধ্যভ্রমণে বের হতেন এবং নিজের শিক্ষা ও শিল্পরুচি দিয়ে স্ত্রীকে সুশিক্ষিতা করে তুলেছিলেন।

ভারত-ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত নাটকগুলির প্রধান উপজীব্য ছিল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। প্রহসনে সমাজের নানা সমস্যার প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল। তিনি মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি সংস্কৃত, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার বহু সংখ্যক নাটক বাংলা অনুবাদ করেন। নাটকের অনুরূপ সংগীতেও তাঁর সমান কৃতিত্ব ছিল। তিনি সংগীত রচনা, সুরারোপ ও স্বরলিপি প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত শিল্পী হিসেবেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তাঁর স্বরলিপি গীতিমালা (১৮৯৭) একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

তরুণ বয়সে সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রবীণ বয়সে বীণাবাদিনী (১৮৯৭) এবং সঙ্গীত প্রকাশিকা (১৯০১) নামে সংগীতবিষয়ক দুখানি পত্রিকা প্রকাশ করে তিনি শুধু সংগীতানুরাগের পরিচয় দেননি, একজন সফল সংগীত-সংগঠকের ভূমিকাও পালন করেছেন। তিনি ‘ভারত সংগীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে সংগীতচর্চাকে উৎসাহিত করেন। তিনি সেতার, পিয়ানো ও বেহালা বাদনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।

তিনি পিয়ানো ও বেহালায় নতুন নতুন সুর তুলতেন, আর রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী, স্বর্ণকুমারী প্রমুখ তাতে বাণী বসিয়ে গান রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গীতবিষয়ক অবদানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। সঙ্গীত রচনায় এবং কবিতার ছন্দ ও গানের সুর সম্পর্কে বালক রবীন্দ্রনাথকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথই সচেতন করে তোলেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিচারণ করেন। ভারতীয় রাগসংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতরীতি প্রয়োগের মিলন-প্রয়াসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অগ্রদূত ছিলেন। তিনি ব্রহ্মসংগীত, স্বদেশসংগীত, প্রণয়গীতি প্রভৃতি শ্রেণীর গান রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঠাকুর-পরিবারে ব্রহ্মধর্মের প্রভাব ছিল; দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মোপসনা করতেন।

ব্রহ্মসংগীত ব্রহ্মোপসনার অঙ্গ ছিল। পারিবারিক ধর্মানুভূতি থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্রহ্মসংগীত রচনার প্রেরণা লাভ করেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক প্রকাশিত ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি গ্রন্থমালায় (১-৬ খন্ড) তাঁর রচিত ৬১টি সংগীত সংকলিত হয়েছে। তিনি ১৮৭৬ সালে জাতীয় সংগীত নামে দেশাত্মবোধক একটি গীতসঙ্কলন প্রকাশ করেন; এতে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথসহ তাঁর নিজের রচিত গান স্থান পায়।

এর পরবর্তী সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি আকারমাত্রিক বাংলা স্বরলিপির প্রচলন করে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন। স্বরলিপিগীতিমালা গ্রন্থে ১৬৮টি গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে; এগুলির মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ছিল ৬৮টি। রাঁচিতেই ৭৬ বছর বয়সে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে এই প্রতিভাদীপ্ত পুরুষ পরলোক গমন করেন ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ।