নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার মাস্টারমাইন্ড মাওনেতা হিদমা

নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার মাস্টারমাইন্ড মাওনেতা হিদমা

রবিবার ছত্তিসগড়ের বিজাপুরে মাওবাদী হামলায় মৃত্যু হয়েছে ২২ সিআরপিএফ জওয়ানের। মনে করা হচ্ছে এই হামলার মূল চক্রী ৫৫ বছরের মাওবাদী নেতা মাদভি হিদমা। ২০০৪ সাল থেকে মোট ২৭টা হামলার অভিযোগ রয়েছে এই হিদমার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আছে ২০১৩ সালের ঘটনা যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের প্রায় গোটা কংগ্রেস নেতৃত্বই। আছে ২০১০ সালের দান্তেওয়াড়া কাণ্ড যাতে মৃত্যু হয়েছিল ৭৬ জন সিআরপিএফ জওয়ানের।কে এই হিদমা যাকে নাগালে পেতে এখনও ব্যর্থ প্রশাসন?

ছিপছিপে শরীর। রোগাটে গড়ন। চেহারায় চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু নজর কাড়বে কঠোর-হিমশীতল দৃষ্টি। চাহনির কাঠিন্যে ঝরে পড়ে আগ্রাসী মনোভাব আর হার-না-মানা জেদ। দণ্ডকারণ্যের নিকষ কালো অরণ্যে হিলহিলে শরীরটা নিয়ে একদল ব্যাটেলিয়ানকে পরিচালনা করে সে। যদিও বস্তারের স্থানীয় আদিবাসীরা মনে করে, 'হিডমালু' ওরফে 'সন্তোষে'র কোনও শরীরই নাকি নেই।

তবু ভক্তিভরে তার দলে নাম লেখায় শয়ে শয়ে মানুষ। 'কায়াহীন ছায়া'-র দাপটে আপাতত ঘুম উড়েছে রায়পুর থেকে দিল্লির। সাম্প্রতিক বস্তার-এনকাউন্টারের মাস্টারমাইন্ড, ন'য়ের দশক থেকে পুলিশের খাতায় 'মোস্ট ওয়ান্টেড' হিডমা-কে ধরতে নতুন করে নীল নকশা বুনতে হচ্ছে জওয়ানদের। কিছুটা মিথ, কিছুটা বাস্তব। দুইয়ের মিশেলে হিডমার যে চেহারা গড়ে উঠেছে সেটা বেশ আকর্ষণীয়। গত শনিবার ছত্তিশগড়ের সুকমা-বিজাপুর সীমান্তে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালায় একদল মাওবাদী।

তখনই জানা যায়, এই সংঘর্ষের মূল চক্রী হিডমা। যদিও তার খবরের শিরোনামে আসার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও অরণ্যঘেরা বস্তারভূমিতে বারবার ত্রাস সৃষ্টি করেছে সে। ঘটিয়েছে একাধিক হামলার ঘটনা। যাতে প্রাণ হারিয়েছেন সেনা জওয়ান থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অনেকে। আটকের জন্য অভিযান চালাতেও পিছপা হয়নি সেনা। তবু অরণ্যের জটিল আবর্তে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে হিডমা। আদিবাসীদের মুখে কুলুপ। চাপের মুখেও হিডমার অবস্থান কিংবা গতিবিধি নিয়ে একটি বাক্য খরচ করেনি তারা।

প্রশ্নের উত্তরে স্রেফ মনে করিয়ে দিয়েছে তার লুকোনো নামটুকু. 'হিডমালু'… 'কায়াহীন ছায়া' এই হিডমা। তাকে ধরে কার সাধ্যি! যদিও পুলিশের রেকর্ড বুক এতকিছু লোকপ্রবাদে ভরসা রাখে না। গোয়েন্দা রিপোর্ট জানাচ্ছে, খাতায়-কলমে হিডমার মূলত দু'টি পরিচয় রয়েছে। এক, সে পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মির ১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের প্রধান। আর দুই, সিপিআই-এর মাওবাদী শাখার দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির সক্রিয় সদস্য।

অবশ্য হঠাত্‍ একদিন উল্কার গতিতে হিডমার এই উত্থান নয়। প্রথম জীবনে ছাপোষা আদিবাসীর মতোই জীবন কাটছিল তার। এমনকী ক্লাস টেন পর্যন্ত আর পাঁচজনের মতোই স্কুলে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ফেলে সে। দক্ষিণ সুকমার পুর্বাতি গ্রামে 'খেতিবারি'-র কাজ করেই বাকি জীবন কাটানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল হিডমা।হঠাত্‍ করে ঠিক তারপরই অন্য খাতে চলতে শুরু করে সে। যোগ দেয় নকশাল বাহিনীতে।

প্রথমে দলের তৃণমূল স্তরে কর্মীর ভূমিকা পালন করত হিডমা। এরপর ধাপে ধাপে প্রমোশন। প্রথমে সামরিক অভিযানের ছক কষা, তারপর গেরিলা হানার পুরোভাগে নিজেকে মেলে ধরে হিডমা। সুকমা, বিজাপুর, দক্ষিণ বস্তার, দান্তেওয়াড়ায় স্থানীয় আদিবাসী মহলেও ছাপ ফেলতে শুরু করে সে। বিষয়টা এতদূর গড়ায় যে, ইদানীং জনপ্রিয়তার নিরিখে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বাসবরাজুর চেয়েও দলে হিডমা অনেকটা এগিয়ে। ঠিক কোন রহস্যে বারবার অভিযানে গিয়েও বেঁচে ফিরে আসে হিডমা?

গোয়েন্দা মহলের বক্তব্য, এই মাও-নেতা নিজেকে সবসময় ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ে মুড়ে রাখেন। কঠিন সেই জাল কেটে হিডমাকে ধরাটা নাকি কার্যত অসম্ভব! শুধু তাই নয়। কোনও এক জায়গায় বেশিদিন ঘাঁটি গেড়ে থাকে না হিডমা। দ্রুত জায়গা বদলানো এবং জঙ্গল মহলে মোবাইল নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি তাকে ধরতে না পারার অন্যতম কারণ। তাছাড়া আজন্ম জঙ্গলেই বেড়ে উঠেছে হিডমা আর তার অনুগামীরা। এখানকার দুর্গম সমস্ত অঞ্চল তাদের নখদর্পণে।

যার জেরে পুলিশি-ফাঁদ কেটে বেরোনোটা অসম্ভব কিছু নয়। আর এতগুলো রক্ষাকবচের উপর নির্ভর করে বছরের পর বছর সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে হিডমা-বাহিনী। যার সূত্রপাত ২০০৩ সালে। ঝিরাম জেলায় কংগ্রেসের পরিবর্তন যাত্রায় হামলা চালায় মাওবাদীরা। মারা যান ২৯ জন। প্রাণ হারান কংগ্রেসের তত্‍কালীন রাজ্য সভাপতি নন্দকুমার প্যাটেল এবং দলের শীর্ষ নেতা বিদ্যাচরণ শুক্লা।

এরপরের হামলা ২০১৭ সালে। ১২ মার্চ ছত্তিশগড়ের ভেজি জেলায় হিডমার নেতৃত্বাধীন মাওবাদী হামলায় ১২ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়। ৬ মে, ২০১৭ সালেও সুকমাতে বড়সড় হামলা করে তারা। সবশেষে ৯ এপ্রিল, ২০২১-এর ঘটনা। যাতে প্রাণ হারালেন ২৩ জন সেনা জওয়ান।

[ আরও পড়ুন সত্যজিৎ রায় ]