কপিল মুনির কিছু পৌরাণিক কাহিনী

বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপে প্রত্যেক বছর আয়োজন হয় গঙ্গাসাগর মেলার। কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গঙ্গায় পবিত্র স্থান করতে সেখানে দূর দূর থেকে আসেন লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। গঙ্গা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মিলিত স্থানকে বলা হয় গঙ্গাসাগর। এটি একাধারে যেমন তীর্থভূমি, আবার অন্যদিকে মেলাভূমি।
এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই গঙ্গাসাগর মেলা। কুম্ভ মেলার পর গঙ্গাসাগর মেলা দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু মেলা। বাংলার বাইরে ও বিহার উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্য থেকেও প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীরা পবিত্র তীর্থস্থান লাভের আশায় ভিড় জমান। কথিত আছে ইক্ষাকু বংশের রাজা সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। ভীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ কপিল মুনির অজান্তেই ঘোড়া চুরি করে বেঁধে রাখেন তাঁর আশ্রমে। রাজার ষাট হাজার সন্তান ঘোড়া খুঁজতে এসে উপস্থিত হন আশ্রমে। না বুঝেই তাঁরা মুনিকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন।
কপিলমুনি রেগে গিয়ে তাঁদের অভিশাপ দেন এবং তাঁরা ভস্মীভূত হয়ে যায়।এদিকে সগর রাজবংশের উত্তরপুরুষ ভাগীরথ, মহাদেবকে তুষ্ট করে পতিত পাবনী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্তে নিয়ে আসেন। গঙ্গার ধারার ভষ্মিভূত সেই সন্তানরা পুনর্জীবন লাভ করে সশরীরে স্বর্গে ফিরে যান। আর এই কারণেই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।শোনা যায় মহাভারতের বনপর্ব তীর্থযাত্রায় গঙ্গাসাগরের কথা বলা আছে।এছাড়াও পাল বংশের রাজা দেবপাল একটি লিপিতে তাঁর গঙ্গাসাগর সঙ্গমে ধর্মানুষ্ঠান করার কথা বলেছিলেন।
লোককাহিনী অনুযায়ী এখানে কপিলমুনির আশ্রম ছিল। একসময় সে যে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে আশ্রম এটিকে কেন্দ্র করে তাঁর ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। একজন বৈদিক ঋষি ছিলেন কপিল। তাঁকে সংখ্যা দর্শনের অন্যতম প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। ভগবত গীতায় কপিলকে সিদ্ধাচল উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও হিন্দু প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে তিনি ব্রহ্মার পৌত্র মনুর বংশধর। আবার অনেকে বলেন কপিল হলেন বিষ্ণু ভক্ত অসুররাজ প্রহ্লাদের পুত্র।
আরও শোনা যায়, ষোড়শ শতকের প্রাচীন পুঁথির তীর্থতত্ত্বপ্রদায়িনীতে কপিল মুনির মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। এক সময়ের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা ‘হরকরা’-য় ১৮৩৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে এক প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাতে লেখা হয়েছে, ‘‘এই স্থানে যে এক মন্দির আছে তাহা লোকের কাছে ১৪০০ বছর হইল গ্রথিত হইয়াছে।
এই মন্দিরে কপিল মুনি নামে প্রসিদ্ধ দেবরূপ এক সিদ্ধপুরুষ প্রতিষ্ঠিত আছেন।"যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সূর্যবংশীয় রাজা বৃহদবল নিহত হয়েছিলেন। ভগীরথ তাঁর পূর্বপুরুষ। উভয়ের মধ্যে ৫২ পুরুষের ব্যবধান। ৫৩ পুরুষে ১৩০০ বছর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৪১ অব্দে। অতএব ভগীরথ খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৪১ অব্দে ছিলেন। এই সময়ে কপিল মুনির আশ্রম ছিল।তাই কথায় বলে সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।