বৃহদীশ্বর মন্দির

বৃহদীশ্বর মন্দির

যে কোনো স্থাপত্য তৈরির আগে দরকার তার ভিত। এর জন্য গর্ত কেটে ভিত তৈরি করতে হয়। বাড়ি তৈরিই হোক, কিংবা মন্দির ভিত ছাড়া কোনো নির্মাণ তৈরির কথা যেখানে ভাবাই যায় না, সেখানে ভিত ছাড়াই ভারতের মাটিতে তৈরি হয়েছে প্রায় ২১৬ ফুট উঁচু মন্দির, মন্দিরের চূড়ায় রয়েছে ৮০ টন ওজনের পাথর।

এতক্ষণ যে মন্দিরের কথা বলা হলো, তার নাম Brihadiswara Temple বৃহদীশ্বর মন্দির। বৃহৎ মানে বড়ো এবং ঈশ্বর মানে এখানে দেবাদিদেব শিব। সোজা কথায়, এটি শিবমন্দির।মন্দিরটির নির্মাতা দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ‍্যের তাঞ্জাবুরের চোল শাসক প্রথম রাজরাজ চোল। সেজন্য শাসকের নামে মন্দিরটির আরেক নাম রাজরাজেশ্বর মন্দির, যার অর্থ চোল সম্রাট রাজরাজ চোলের ঈশ্বর।

৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঞ্জাবুরের চোলরাজ উত্তম চোলের মৃত্যুর পর চোলরাজ‍্যের সিংহাসনে বসেন এই প্রথম রাজরাজ চোল। তিনি ছিলেন চোলরাজ সুন্দর চোলের কনিষ্ঠ পুত্র। পূর্ববর্তী রাজা উত্তম চোল ছিলেন সুন্দর চোলের জেঠতুতো ভাই।গৃহবিবাদের জেরে সুন্দর চোলের পর তাঁর জেঠতুতো ভাই উত্তম চোল রাজা হয়েছিলেন এবং উত্তম চোলের পর রাজা হোন প্রথম রাজরাজ চোল।

তাঁর আসল নাম অরুমোলিবর্মা। কিন্তু প্রথম রাজরাজ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। সিংহাসনে বসে তিনি "রাজকেশরী" ও "মুম্মডিচোল" উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন বানবন মহাদেবী। এক বিরল সামরিক প্রতিভা ও অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি ছিল প্রথম রাজরাজ চোলের। স্থাপত‍্য, ভাস্কর্য, সাহিত্য ও ধর্মের ক্ষেত্রে চোলরাজ‍্য গৌরবের চরম শিখরে উঠেছিল তাঁর সময়।

তাঁর আমলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তৎকালীন শৈলেন্দ্ররাজ মারবিজয়োত্তুঙ্গবর্মার সঙ্গে যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল বলে তাঁর লাইডেন তাম্রশাসন থেকে জানা যায়। ফিরে আসি বৃহদেশ্বর মন্দিরের কথায়। চেন্নাই থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কাবেরি নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই মন্দিরটি বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত।

মন্দির এলাকার আয়তন পূর্ব-পশ্চিমে ৭৯০ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪০০ ফুট। বড়ো বড়ো থাম ও বারান্দা রয়েছে মন্দিরের অংশ হিসেবে।জানা যায়, মন্দির তৈরির জন্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে ৩ হাজার হাতি দিয়ে ১.৩ মিলিয়ন টন গ্রানাইট পাথর বয়ে আনা হয়েছিল। বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের সঙ্গে এই মন্দির তৈরির প্রযুক্তির মিল নেই।

কারণ, পুরো মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ভিত ছাড়াই সম্পূর্ণ ইন্টারলকিং পদ্ধতিতে, যে প্রযুক্তি প্রায় এক হাজার বছর আগের ভারতবর্ষে সত্যিই বিষ্ময়কর! আর পাথরের মধ্যে কোনোরকম প্লাস্টার, আঠা বা সিমেন্টের মতো কোনো কিছুই ব‍্যবহার করা হয়নি।পিসার হেলানো টাওয়ার তৈরির কয়েক বছর পরেই মাটিতে ঝুঁকে গেছে,

কিন্তু তার বহু আগে তৈরি এই বৃহদীশ্বর মন্দির তার অক্ষ থেকে সরে নি। হাজার বছরে অন্তত ছয়টি বড়ো ভূমিকম্প ঘটে গেছে এই এলাকায়, তবুও বৃহদীশ্বর মন্দির অটুট।প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য বিদ‍্যা যে কত উন্নত ছিল, আজকের তথাকথিত ফেঙসুই তার কাছে নিতান্তই নগণ্য, তার প্রমাণ তাঞ্জাবুরের এই বৃহদীশ্বর মন্দির।