বাগনান

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হাওড়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল বাগনান Bagnan।উলুবেড়িয়া সাব ডিভিশনের অন্তর্গত বাগনান, বিধানসভা কেন্দ্র হিসেবে বাগনান-১ ও বাগনান-২উন্নয়ন ব্লক এই দুটি ভাগে বিভক্ত।বাগনান রেল স্টেশনটি বাগনান-২ উন্নয়ন ব্লকের মধ্যে অবস্থিত।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখা গেলে শহরটি ২২.৪৭° উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৭.৯৭° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর অবস্থান করছে। শহরটিকে বেষ্টন করে হুগলি নদী পূর্ব সীমানা বরাবর প্রবাহিত এবং অন্যদিকে রূপনারায়ণ নদ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে হাওড়া জেলার প্রাকৃতিক সীমানা নির্দেশের মাধমে প্রবাহিত হয়েছে।
বাগনান-১ উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি হল যথাক্রমে বাগনান-১,বাগনান-২,বাঙালপুর,হাতুরিয়া-১,হাতুরিয়া-২ ও খালোর গ্রাম পঞ্চায়েত।বাগনান-২ ডেভলপমেন্ট ব্লকের অন্তর্গত সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত হল যথাক্রমে আন্টিলা, বাঁটুল বৈদ্যনাথপুর, চন্দ্রভাগ, হাল্যান, মুগকাল্যান, ওড়ফুলি ও শরৎচন্দ্র গ্রাম পঞ্চায়েত।
১৭২২ সালে বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলী খাঁ’র আমলে ভূমিরাজস্ব বিধি সংশোধন হওয়ার ফলে প্রায় সমগ্র হাওড়া জেলা বর্ধমান জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯৫ সাল নাগাদ বর্ধমান জেলা থেকে আলাদা করে হাওড়া ও হুগলি জেলাকে মিলিয়ে হুগলি জেলা তৈরি হয় এবং বাগনান সেই সময় হুগলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাগনান নিয়ে একটি লৌকিক ছড়া প্রচলিত ছিল বহু আগে- দুলে কাপালি মুচুরমান এই তিন নিয়ে বাগনান।
দুলে জাতের বসবাস সারা বাংলা জুড়ে থাকলেও বাগনানে বেশি ছিল। এদের পেশা মাছ ধরে বিক্রি করা। কাপালি জাত হল ভারতীয় পাট শিল্পের জনক। আর মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস বাগনানে অনেক আগে থেকেই। বিখ্যাত সফরদান পীর সাহেবের সমাধি এই এলাকাতেই অবস্থিত।এখানকারই ভূমিপুত্র বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘হাওড়া জেলার গ্রামনাম’ বইটিতে বাগনান নামটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন।
বাগনান শব্দটিকে সন্ধি বিচ্ছেদ করলে বাগ+নান এই দুটি শব্দ পাওয়া যায়।এই নান শব্দের অর্থ দুটি– আরবী ভাষায় রুটি এবং গঞ্জ দুটোই বোঝায়। বাগ শব্দটি এসেছে দেবী বাগেশ্বরী থেকে। বৃন্দাবনতলার মাঠে বাগেশ্বরী দেবীর মন্দির ঘিরে যে বাজার বা গঞ্জ বসে তাই কালক্রমে ‘বাগনান’-এ এসে দাঁড়ায়। একইভাবে পিপুলগাছের নীচে যে বাজার তাকে ঘিরে গ্রাম পিপুলনান।
সাধারণত একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে নান উপাধির গ্রামগুলি বেশীরভাগই মুসলমান প্রধান। যেমন হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলি পুর দিয়ে শেষ হয়। যেমন কমলপুর , শ্রীরামপুর,— আবার মিশ্র উদাহরণের ব্যতিক্রম আছে— নতিবপুর—।এখানকারই আরেকটি গ্রাম ‘বাউনধুকরে’। এই নামটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে তারাপদ বাবুর মত হল গ্রামটি যিনি পত্তন করেন তিনি নিজের নাম না দিয়ে যে ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুকুর পূজা করিয়েছিলেন তাকেই সম্মান জ্ঞাপন করে এই নাম রাখেন।
এখন পুকুর হিসেবে যা পূজিত হয় তা আসলে গেঁড়ি শামুকে ভরা ডোবা। গেঁড়ি ভরা ডোবা গ্রামের কথায় গেঁড়িয়া। বামুন পূজিত গেঁড়িয়া – সেখান থেকে বামুন দেওয়া গেঁড়িয়া কালে কালে লোকমুখে হল বাউন-দে-গেঁড়িয়া এবং উত্তরকালে বাউনদুকুড়িয়া বা বাউনধুকরে।এই বাগনান যে একসময় বাংলার বীর সন্তান ক্ষুদিরামকেও দেখেছে তা আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানে না। হাওড়ার বাগনানের দেউলগ্রামে ছিল ক্ষুদিরাম বসুর মামাবাড়ি।
বাগনান পেয়েছে কাজী নজরুলের পাদস্পর্শও। ১৯২৬ সালের জুন মাস নাগাদ কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন উপলক্ষে বাগনান থানার আগুনসি গ্রামে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি।উদ্যোক্তা ছিলেন বাগনানের ভূমিপুত্র বিভূতি ঘোষ।’ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ এবং ‘ মঞ্জুষা’ পত্রিকায় নজরুলের সেদিনের সেই আগমনের খবর প্রকাশিত হয়। নজরুলের বয়স তখন ২৭।
বাগনান ষ্টেশন থেকে হেঁটে এক সুবিশাল পদযাত্রার সাথে চার কিমি দূরের আগুনসি গ্রামে পৌঁছন।সেদিন বিনা মাইকে কেবল হারমোনিয়াম সহযোগে নিজের লেখা ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ এবং ‘ ওঠ রে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’ গান দুটি গেয়েছিলেন।বাগনানের সবথেকে ঐতিহ্যশালী স্কুল বাগনান হাই স্কুল যা ১৮৫৪ সালে স্থাপিত হয়। চন্দ্রপুর গ্রামের জমিদার হেমচন্দ্র ঘোষ এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।বাগনানে পনেরোটির বেশী বাংলা মাধ্যম হাই স্কুল এবং একটি কলেজ রয়েছে, বাগনান কলেজ।
বাগনানের শিক্ষাভুবনে ‘দি স্কলার স্কুল’ এক নবতম সংযোজন।বাগনানের রবিভাগ গ্রামে দামোদর নদের পাশে হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘দি স্কলার স্কুল’ একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা বাংলা এবং আসামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির কাছে শিক্ষার অধিকার পৌঁছে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।বাগনানের বিখ্যাত হাট বাকসিহাট।
বাগনানের ঐতিহ্যশালী প্রাচীন পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম চন্দ্রভাগ গ্রামের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজো। বাগনানের অন্যতম প্রাচীন মন্দির খালোড়ের বিখ্যাত কালী মন্দির। বনেদী বাড়ির পুজোর মধ্যে অন্যতম বাগনানের নন্দীবাড়ির পুজো।এখানে এখনও সন্ধিপুজোর আগে ফায়ারিং করা হয়। তারপর শুরু হয় অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণের পুজো।বাগনানের রথতলা সংলগ্ন এলাকায় বাস নন্দী পরিবারের।নন্দী পরিবারের আদি বাসস্থান হুগলির শিয়াখালার পাতুল গ্রাম।
পাতুল গ্রামে নন্দী পরিবারে ঠিক যে রীতিতে পুজো হয়, সেই ধারা বজায় রেখে এখনও পুজো হয় হাওড়ার বাগনানের বাড়িতেও।এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য এ বাড়ির পুজোর সঙ্গে বাংলার পরাক্রমী বিপ্লবী বাঘাযতীনের একটি যোগসূত্র আছে। অনেকের-ই অজানা বাঘাযতীন দীর্ঘদিন বাগনানে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন এবং এখানকার অন্যতম প্রাচীন স্কুল বাগনান হাইস্কুলে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা লুকিয়েছিলেন।
এখান থেকেই বাঘাযতীন বালেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করবেন বলে।তার আগে এই নন্দী বাড়ির দুর্গাপুজোয় হাজির হয়ে দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে গিয়েছিলেন।বাগনান থানার অন্তর্গত হারোপ গ্রামের চক্রবর্তী বাড়ির দক্ষিণাকালী ‘বুড়িমা’ নামে খ্যাত। প্রায় চারশো বছরের অধিক প্রাচীন এই প্রতিমাকে নিয়ে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত।লক্ষ্মীপূজার জন্য আমতার জয়পুর থানার খালনার নাম বেশী পরিচিত হলেও বাগনান থানার অন্তর্গত জোকা গ্রামের লক্ষ্মী পূজাও কিন্তু একই সমারোহে পালিত হয়। খালনায় মাতৃরূপে পূজিত হন দেবী অন্যদিকে জোকায় হন কন্যারূপে।